উম্মাদের হাতে গণতন্ত্রের চাবিকাঠি
সম্প্রতি ফিনান্সিয়াল টাইমসকে ড. ইউনূস বলেছেন,
"In the short run, definitely she has no place — the Awami League doesn't have a place — in Bangladesh,"
"They controlled the people, they controlled the [political] machinery, they controlled the institutions to enhance their interest" "No fascist party should be in existence in a democratic system,"
বাংলা করলে দাঁড়ায়, নিকট ভবিষ্যতে শেখ হাসিনার স্থান বাংলাদেশে হবে না। আওয়ামী লীগের স্থান বাংলাদেশে হবে না। তারা মানুষকে নিয়ন্ত্রণ করেছে, রাজনৈতিক কাঠামোকে নিয়ন্ত্রণ করেছে, নিজেদের স্বার্থে দেশের প্রতিষ্ঠানগুলোকে নিয়ন্ত্রণ করেছে। গণতান্ত্রিক ব্যবস্থায় কোনো ফ্যাসিস্ট দল থাকতে পারে না।
ড. ইউনূসের কথা শুনলে আপনার মনে প্রথমেই যে প্রশ্নের উদয় হবে, তা হলো, "ইউনূস কে? এসব কথা বলার অধিকার সে কিভাবে পেলো?" বাংলাদেশের সংবিধান রক্ষার শপথ নেয়া ভদ্রলোকটি সংবিধানের চরম অবমাননা করে অবৈধভাবে ক্ষমতা দখল করেছেন। সুতরাং আওয়ামী লীগ, বিএনপির মতো বড়ো দল দূরে থাক, জামানত বাজেয়াপ্ত হওয়া জুনায়েদ সাকির দল নিয়েও এরকম কোনো প্রশ্ন ইউনূসের মুখে শুনতে হাস্যকর লাগে। তবে বাংলাদেশে যেহেতু আমেরিকান এক নাগরিক দিয়ে সংবিধানকেই নোতুন করে লেখার কার্যক্রম চলছে, সেহেতু আমেরিকার আরেকটি পাপেটের বাংলাদেশের গণতন্ত্র নিয়ে প্রশ্ন করার অধিকার আছে কি না, সে প্রশ্ন আপাতত মূলতবি রেখে তার বক্তব্যে যাই।
ইউনূস প্রথমেই বলেছেন, অদূর ভবিষ্যতে বাংলাদেশে শেখ হাসিনার কোনো স্থান হবে না। এতোদিন কিন্তু আমরা উল্টোটাই শুনে আসছিলাম। "গণহত্যা"র জন্য শেখ হাসিনার বিরুদ্ধে শ' তিনেক মামলা হয়েছে, হাজার হাজার কোটি টাকা দুর্নীতি করেছেন শেখ হাসিনা, সেগুলোরও বিচার করা হবে। কিন্তু আজ ইউনূস তাকে বাংলাদেশেই ঢুকতে দিতে চান না। আশ্চর্য কারবার! যেখানে ভারতের ওপর আন্তর্জাতিক চাপ সৃষ্টি করে শেখ হাসিনাকে ধরে এনে বিচার করে ফাঁসিতে ঝুলানোর চেষ্টা করা স্বাভাবিক ছিলো, সেখানে এ কী কথা শুনি আজ ইউনূসের মুখে! সত্য হলো, ইউনূস ভয় পেয়েছেন। তিনি জানেন, শেখ হাসিনা কী জিনিস। শেখ হাসিনা বাংলাদেশে ব্যাক করা মানে ইউনূসের ভবলীলা সাঙ্গ হওয়া। তাঁর বিরুদ্ধে করা তথাকথিত গণহত্যার গণমামলা এমনকি তাইজুলের আদালতেও টিকবে না। আবার ৩ মাস হয়ে গেলো, শেখ হাসিনা দুর্নীতি করে কোন সুইস ব্যাঙ্কে কতো টাকা পাচার করেছেন, এরকম কোনো কানাঘুষাও ইউনূস সরবরাহ করতে পারছেন না। গণভবনের সিন্দুক লুট করে পাওয়া গেছে সাকুল্যে ১৬ লাখ টাকা। সুতরাং শেখ হাসিনাকে দেশে এনে বিচার করার ভাওতাবাজিতে কোনো কাজ হবে না। আওয়ামী লীগ নেতাদের ওপর লীগের মানুষজন মহাবিরক্ত থাকলেও শেখ হাসিনা সবসময়ই জনপ্রিয় ছিলেন। আর গত ৩ মাসে ইউনূসের অত্যাচারই আওয়ামী লীগকে আবার মনেপ্রাণে এক করে দিয়েছে। সুতরাং শেখ হাসিনা ইন মানে ইউনূস তার তল্পিতল্পাসমেত আউট।
এবার আরেকটু সিরিয়াস প্রসঙ্গে যাই। ইউনূস এবং সুশীল সমাজ কথায় কথায় মুখে গণতন্ত্র আওড়ান। তাদের গণতন্ত্র আসলে কী? ওয়ান ইলেভেনের সময় আওয়ামী লীগ এবং বিএনপিকে দিনরাত গালি দিয়ে আবার সেই ২ দলের নেতাদেরকে নিয়েই ইউনূস নাগরিক শক্তি গঠন করতে চেয়েছিলেন। ব্যর্থ হয়েছিলেন। ধরি, আওয়ামী লীগ খুব খারাপ চালিয়েছে গত ১৫ বছর। লোকজনকে পরপর ৩টি নির্বাচনে ভোট দিতে দেয় নি। তাহলে তো ইউনূসের কাজ খুব সোজা। এখন সে নিজেই প্রশাসন। সে সুষ্ঠু নির্বাচন দিক। লোকজন আওয়ামী লীগের ওপর অসন্তুষ্ট থাকলে তাদেরকে ভোট দিবে না। লোকজন যদি বিএনপির ওপর অসন্তুষ্ট থাকে, তাহলে বিএনপিকেও ভোট দিবে না। ইউনূস যদি মনে করেন, লোকজন তাকে চায়, তাহলে তিনি একটি রাজনৈতিক দল বানিয়ে নির্বাচনে অংশগ্রহণ করুন। যেহেতু তিনিই সরকারে, সেহেতু ভোট চুরিও তিনি ঠেকাতে পারবেন। জনগণ আওয়ামী লীগ, বিএনপিকে বর্জন করে তাকে বা তার মিত্রদেরকে ভোটে জেতাবে।
কিন্তু তিনি নির্বাচন করবেন না। কারণ, গণতন্ত্রের বুলি হলো তার এবং তাদের ভাওতাবাজি। তারা যে কোনো মূল্যে ক্ষমতার কেন্দ্রবিন্দুতে থাকতে চান, সেটি কর ফাঁকি দিয়ে অর্জিত টাকার ক্ষমতাই হোক বা রাষ্ট্রক্ষমতা। তারা গণতন্ত্রে মোটেই বিশ্বাস করেন না। আম-পাবলিককে মূর্খ মনে করেন, ঘৃণা করেন, দেশের লোকজন "গণতন্ত্রের জন্য প্রস্তুত নয়" - এমন চরম স্বৈরতান্ত্রিক মনোভাব ধারণ করেন। গণতন্ত্র হলো জনগণের ইচ্চার প্রতিফলন। আপনি মহা পণ্ডিত, আপনারও এক ভোট, ক্লাস ফাইভ ফেল কৃষকেরও এক ভোট। কারণ, গণতন্ত্রের চোখে মানুষ হিসেবে সবাই সমান। জনগণদ্বারা নির্বাচিত প্রতিনিধি জন আকাঙ্ক্ষার প্রতিফলন ঘটাতে ব্যর্থ হতে পারে। কিন্তু তার জন্য জনগণের প্রতিনিধি নির্বাচনের অধিকারকে কেঁড়ে নেয়া যায় না। জনগণ ভুল করতে পারে। সে ভুল সংশোধনের উপায়ও জনগণই বের করবে। আপনি মহাপণ্ডিতের পাণ্ডিত্য এখানে চলবে না। দরিদ্র জনগণকে ঠকিয়ে আপনি ব্যবসা করতে পারবেন। কিন্তু তাদের রাজনীতির জ্ঞান আপনার চেয়ে কম, এটি মনে করার কোনো কারণ নেই। তারা রাজনীতির মধ্যেই বসবাস করেন। আম-জনতার সংগ্রামের জীবন দেশের রাজনীতি দ্বারা যতোটা প্রভাবিত হয়, তুলনামূলক ভালো অবস্থানে থাকা শিক্ষিত ও ধনী লোকজনের ওপর সেই প্রভাব অনেকটাই কম।
গণতন্ত্রে বিন্দুমাত্র বিশ্বাসী হলে বাংলাদেশে আওয়ামী লীগের স্থান হবে না, এরকম হঠকারী বক্তব্য দেয়া সম্ভব নয়। ইউনূস সাথে সাথে আরো কয়েটি বিশেষণ জুড়ে দিয়েছেন। আওয়ামী লীগকে "ফ্যাসিস্ট" সংগঠন হিসেবে ঘোষণা দিয়ে দিচ্ছেন। আমার ধারণা, উনি ফ্যাসিস্ট শব্দের অর্থই জানেন না। তার আশেপাশের জামায়াত-হিজু-বামরা এই শব্দটা ব্যবহার করে, এখানে থেকেই তিনি মেরে দিয়েছেন। এই শব্দটি নুরুল হক নুর এবং জুনায়েদ সাকিরা গত ১৫ বছরে (এবং তার আগেও) অহরহ ব্যবহার করেছে। পাবলিক মিডিয়ায়। তাদেরকে কেউ মিডিয়ায় নিষিদ্ধ করে নি। আওয়ামী লীগ (বা তারও আগে বিএনপি) "ফ্যাসিস্ট" হলে মিডিয়া দূরে থাক, নিজদলের সভায়ও এরকম কিছু বলে তারা অক্ষত থাকতো না।
তবে কথা সেটি নয়, কথা হলো জুনায়েদ সাকিরা টক শো বা রাজনৈতিক বক্তৃতায় দায়িত্ব না নিয়ে যে কথা বলতে পারে, দেশের (যদিও অবৈধ) সরকার প্রধান হিসেবে ড. ইউনূস সে কথা বলতে পারেন না। কোনো দলকে মুখে বলে দিলাম আর ফ্যাসিস্ট হয়ে গেলো, বিষয়টা তো এমন না। বিষয়টা আদালতের মাধ্যমে প্রমাণিত হয়ে আসতে হবে। সে আদালত এমনকি যদি তাইজুলের আদালতও হয়, তবুও এই ফর্মালিটি ইউনূসকে মেইন্টেইন করতেই হবে। আদালত যদি আওয়ামী লীগকে ফ্যাসিস্ট বলে রায় দেয়, তখন ইউনূস এই শব্দটি জপ করলে তবু একটা অর্থ থাকে। কিন্তু তিনি আর ধৈর্য্য রাখতে পারছেন না। এখনই লাফ দিয়ে বিদেশি মিডিয়ায় গিয়ে বাংলাদেশের সবচেয়ে বড়ো রাজনৈতিক দলকে ফ্যাসিস্ট বলে দিলাম, এটি শুধুমাত্র বলার জন্য বলা। এখানে দায়িত্বহীনতা ছাড়া আর কিছু নেই।
আমি জানি, ইউনূসের এরকম বক্তব্যকে অনেকেই পাগোলের প্রলাপ বলে উঁড়িয়ে দিবেন। মেটিকুলাস ডিজাইনের কথা ফাঁস করে তিনি নিন্দিত হয়েছেন। এরপর রিসেট বাটনে টিপ মেরে তো তিনি নিজের ভাবমূর্তিকেই ফ্যাক্টরি রিসেট করে ফেলেছেন। এখন আবার আওয়ামী লীগের মতো দলকে ভ্যানিশ করতে চান। আওয়ামী লীগ ভেঙ্গে টুকরো টুকরো হয়ে যাবে, এই স্বপ্ন দেখেন। সাথে যদি যোগ করেন, সোহেল তাজকে ফোন করে শলাপরামর্শের ব্যাপারটা, তাহলে ইউনূসের মানসিক অসুস্থতা নিয়ে আপনার কোনো সন্দেহ থাকবে না। কিন্তু সমস্যা অন্য যায়গায়, অবোধ শিশুর হাতে দেশলাইয়ের কাঠি নিরাপদ নয়। বদ্ধ উম্মাদের হাতেও গণতন্ত্র ও দেশের চাবিকাঠি নিরাপদ নয়। দেশটা আপনার। দেশটাকে ভবিষ্যতে কোথায় দেখতে চান, সে চিন্তা এবং কাজের দায়িত্বও আপনার।